নরসুন্দর আর কিছু খুচরো গপ্পো, শেষ কিস্তি

নরসুন্দর আর কিছু খুচরো গপ্পো, শেষ কিস্তি:
পূর্বেঃ নরসুন্দর আর কিছু খুচরো গপ্পো
ছোটবেলায় যে জননী চুল অল্প বড় হলেই ধরে ছোট করে দিতেন, ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পরে সেই জননীই চুল বড় করতে নীরব সম্মতি দিতেন। এই লাই পেয়ে, মাথায় ওঠা চুল বড় করার গভীর অধ্যবসায়ে নিমগ্ন হতাম। সারাজীবন আর্মি ছাট দেয়া আব্বা, আমার মাথার বাবরি দেখে হতাশ হয়ে মাথা নাড়াতেন, আর বলতেন- ভার্সিটিতে উঠে ছেলেটা আমার সন্ত্রাসী হয়ে গেছে। সন্ত্রাসীদের মনেহয় সর্বদা বড় চুল থাকতে হয়। এই লজিকে সমস্ত নারীকুলও তো সন্ত্রাসী! এ লাইনটা অত্যন্ত ঝুকি নিয়ে লিখলাম। আমার অর্ধাঙ্গী এটা দেখলে নির্ঘাত কয়েক বেলা অর্ধাহারে বা অনাহারে থাকতে হবে। যাই হোক, গোপালদা মানুষটা ভালোই চুল ছাটে।  কিন্তু ঐ যে, মা জননীর লাই, আর নিজের অলসতার কারণে মাথার বাবরি বেড়ে, মাথা ডালি না হওয়া পর্যন্ত সেলুনে যেতাম না। আমার মাথার ডালি দেখে গোপালদা হতাশ হয়ে মুখ কালো করে, কাতর গলায় বলতেন – ছয়মাস পরপর না এসে অন্তত দুইমাস অন্তর আসেন। চুল কাটা শেষে, আমি গোপালদার ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আর সাধারণ রেট পয়ত্রিশ টাকা দিতে পারতাম না। পঞ্চাশ-ষাট টাকা দিয়ে বের হয়ে আসতাম। নরসুন্দরও খুশ। আমিও খুশ। কারণ দুমাস অন্তরের হিসাবে ছয়মাসে খরচ হতো একশো পাচ টাকা। সে হিসেবে অনেক টাকা সেভ করে ফেললুম!
আব্বার কাছে শুনেছিলাম, কানাডায় আব্বার ইউনিভার্সিটির ভিতরের বার্বার শপে চুল ছাটলে নিতো এক ডলার। আর ক্যাম্পাসের বাইরে ছাটলে নিতো তিন ডলার! আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে যাওয়া লাগতো। এ ইনফো শোনার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি অত্যন্ত আশাবাদী। তেতাল্লিশ বছর আগের তুলনায় এখন নিশ্চয় চুল ছাটার রেট বেড়েছে। তাই যদি কখনো বিদেশ-বিভুইয়ে যাওয়া লাগে, তাহলে আমাদের গ্রামের জলিল ভাইয়ের মতন অন্তত গ্রোসারী শপে আলু সাজানো লাগবে না। রাস্তা শর্ট-কাট, দিবো আর্মি ছাট। নো টেনশন।
অবশ্য বিদেশে যাবার আগেই, চাকুরীর সুবাদে ঢাকা ছেড়ে বিজেলায় (অন্য জেলা) যাওয়া লাগলো। জেলার নাম সিলেট। অনেক কারণে সিলেট বিখ্যাত। সিলেট জেলার অনেক বৈশিষ্ট আছে। তবে আমার দৃষ্টিতে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এখানকার ইয়ং জেনারেশনের হেয়ার স্টাইলিং সেন্স। বললে কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, কিন্তু এখানকার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে থেকে শুরু করে, চৌহাট্টা মোড়ের চটপটি বিক্রেতা ছেলের মাথার চুল কালার করা। আর বিভিন্ন ধরনের ছাটতো আছেই। মাথার আর্মি কাটের সাথে চিকন করে বিন্যস্ত দাড়ি, সাইড দিয়ে একদম ছোট আর মাথার মাঝখানে সামনে থেকে পিছনে মুরগীর ঝুটি, মাথার মাঝে খালের মতন আর দুইপাশে খালের পাড় ইত্যাদি অনেক ধরনের চুলের ছাট রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ে। এসব দেখে আমার মতন সাহসী মানুষের (গুলপট্টি নয়- বিবাহিত পুরুষ মাত্রই সাহসী) পক্ষেও এখানে চুল ছাটার দুঃসাহস হয়নি। এখানে থেকেও তাই, কেশ বিন্যাসের কর্মটি, ঢাকায় গোপালদার সেলুনেই সম্পন্ন করতাম।
গত ছয়মাসে নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে একাধিকবার ঢাকাতে এসেও চুল ছাটাতে পারিনি। মাথার চুল ডালপালা মেলতে মেলতে গহীন অরণ্যে পরিনত হয়েছে। অফিসে যাবার আগে গোসল করে, জেল মেরে, চুলগুলো একেবারে স্কালের সাথে বসিয়ে দিয়ে বের হই। এ কর্মটি না করলে উশখোখুশকো চুল দেখে, জুনিয়র কলিগদের কাছ থেকে একটা কথাই সবসময় শুনতে হয়- স্যার মনেহয় ঘুম থেকে উঠে এলেন। আরে ভাই, কেমনে বুঝাই যে, আমার শুকনো চুলবাবাজিরা বাই-ডিফল্ট বেয়ারা। চিরুনী দিয়েও পোষ মানে না। যা হোক, অফিসের বিড়ম্বনা আর বাসায় স্ত্রীর “মাল্লু” “মাল্লু” ডাকের টিটকারীর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে, সিলেটেই চুল ছাটার দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম।
এক জুনিয়র কলিগের পরামর্শ মোতাবেক চলে গেলাম হাবীর ভাইয়ের আলভিরাসে। ইহা একটি বিউটি পার্লারের নাম। তবে এখানে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও রূপসজ্জার ব্যবস্থা রয়েছে। অর্ধাঙ্গী বহু পূর্বে ইহার কথা আমাকে বললেও, গলাকাটা খরচের ভয়ে, পূর্বে এ মুখো হইনি। একটা বিল্ডিং এর পুরোটাই দোকান। ছেলেদের সেলুন দোতলায়। ভিতরে ঢুকলাম। ঝকঝকে তকতকে অন্দরসজ্জা। দেখলাই মনটা ভালো হয়ে যায়। মনটা ভালো হওয়ার সাথে সাথে খানিক অবাক হয়েছিলো, আর মজা পেয়েছিলো, যখন দেখলাম একপাশে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের মাথা বেসিনে রেখে, যত্ন সহকারে শ্যাম্পু করে দিচ্ছিলো এক নরসুন্দর। মজা পাওয়ার কারণ হলো, ভদ্রলোকের মাথার মধ্যখানটা স্টেডিয়ামের মতন ফাকা, আর মূল কেশরাজ্য গ্যালারীর মতন মাথার সাইড দিয়ে বিস্তৃত! মজার দৃশ্যটা হজম করতে না করতেই দেখি ইউনিফর্ম পরিহিত এক নরসুন্দর সামনে এসে দাড়ালো। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে, একটা ক্যাটালগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি ধরনের ছাট আমি দিতে চাই। ভিতরের ইন্টেরিয়র আর এদের ভাবসাব দেখে গলাকাটা দামের ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। লজ্জার মাথা খেয়ে, ছোটলোকের মতন দাম জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। আফটার অল, গরীব মাস্টর বলে কথা!
সাধারণ ছাট দেড়শো টাকা, আর অসাধারণ(ডিজাইনার) ছাট তিনশো টাকা। সাধারণ আর্মি ছাট দিতে বললাম। এ কথা বলার পরে দেখি, আমার নরসুন্দর ওয়েস্টার্ন হিরোদের মতন হোলস্টার পরিধান করছে। তবে পিস্তলের বদলে সেই হোলস্টারের পকেটগুলোতে বিভিন্ন ধরনের চিরুনি আর কেচি। জিনিস পছন্দ হয়েছে। ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ায়। নরসুন্দর প্রথমে আস্তে আস্তে টুকটুক করে মাথার পিছনের চুল কাটা শুরু করলো। তার কাজের ধীরগতি দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, “ভাই, আর্মি কাটতো। মেশিন দিয়ে কাটেন। অনেক তাড়াতাড়ি হবে।” নরসুন্দর বিরক্ত না হয়ে ধীরগতিতেই জবাব দিলো, “আপনার চুল অনেক বড়তো, তাই মেশিন লাগানোর আগে ছোট করে নিচ্ছি। তা না হলে মেশিন আটকে যাবে। ” ব্যাটা আমাকে বুঝিয়ে দিলো যে, আমার চুল লনের ঘাস নয় যে শুধু মেশিন দিয়ে একবারেই কাটা যাবে। জঙ্গলের ঘাসের মতন প্রথমে কাস্তে দিয়ে কেটে ছোট করে নিতে হবে। নরসুন্দর আস্তে আস্তে চুলগুলো সাইজ করে ফেললো। চুল কাটা শেষ হলে, একটা ব্লোয়ার দিয়ে মুখ, ঘাড় আর মাথা ঝেড়ে পরিস্কার করে দিলো। ভেবেছিলাম শেষ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপরে গরম পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে মুখমন্ডল মুছে দিলো। আহা আহা, কি আরাম! এই আরামের জন্যেই ব্যাটার আগের পাকনামী মন থেকে মাফ করে দিলাম। বিল মিটিয়ে বাসায় ফেরত আসলাম। অনুমানমাফিক অর্ধাঙ্গীও জিজ্ঞেস করলো যে, কোথায় চুল ছাটিয়েছি। হাবীব ভাইয়ের দোকানের নাম বললে, বিশ্বাসই করতে চাইলো না। জানতাম এমনই হবে। তাই তৎক্ষণাৎ, ব্যাকাপ প্ল্যান হিসেবে, সাথে নিয়ে আসা হাবীব ভাইয়ের দোকানের বিল চোখের সামনে মেলে ধরতেই রক্ষা।

Comments

Popular posts from this blog

Oscar 2013: tutti i film candidati al titolo di Miglior film straniero, nazione per nazione

Prettypegs